ভারতের সাথে বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি কেন নয়

Oct 03, 2022

150

মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, ২২ মার্চ ২০১৭: শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ কি আদৌ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে, না কি পতাকা-সর্বস্ব সিকিম-ভূটানের ভাগ্যবরণ করে চূড়ান্ত পর্যায়ে সিকিমের মতো হারিয়ে যাবে।

বিভিন্ন নির্ভর যোগ্য সূত্র মতে, শেখ হাসিনার এ সফরের সময় প্রতিরক্ষা কিংবা সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তির আড়ালে ভারত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখার  কমা- সরাসরি ভারতীয় কমা-ের অধীনে নিয়ে চায়। এছাড়া বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ দিবে ভারতীয় বাহিনী এবং সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করতে হবে ভারত থেকে। এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা এবং প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ ইতোমধ্যেই ঢাকায় এসে চুক্তির বিষয়াদি জানিয়ে গেছেন। অজুহাত দেখানো হয়েছে যে, চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয় করায় এবং চীনের সাথে মাখামাখি করায় ভারত নাকি উদ্বিগ্ন। তাই বাংলাদেশের গলায় প্রতিরক্ষা কিংবা সামরিক সহযোগিতা নামক গোলামীর ‘শিকল’ বাংলাদেশকে পরতে হবে। ভারত জানে বাংলাদেশকে গোলাম করতে হলে এর সশস্ত্র বাহিনীর অস্তিত্ব বিলীন করতে হবে। তাই এ ধরনের চুক্তি হবে আত্মহত্যার শামিল।

ভারতের স্বার্থকেন্দ্রিক অজানা সংখ্যক চুক্তি করেও ভারতের ‘খাই খাই’ আবদার  শেষ হয় না। পুরো বাংলাদেশটাকে গিলে না খাওা পর্যন্ত ভারতের স্বস্তি নেই। ভারতের জঘন্য নীতি হলো সুন্দর কথা বলে বলে সুবিধা আদায় করে বাঘের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের আগে ভারত দেখিয়েছে তার মতো স্বার্থহীন বন্ধু আর নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন, বিশেষত ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে  ভারতের চোখ রাতারাতি উল্টে ফেলে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে  প্রায়-পরাজিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বহীন রাখা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য লুণ্ঠন চালায়। পাকিস্তান আমাদেরকে শোষণ করার খোঁড়া হলেও একটা যুক্তি ছিল যে, আমরা পাকিস্তানের অংশ। সে শোষণের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করতে পেরেছিএবং চুড়ান্ত পর্যায়ে আমরা পাকিস্তান থেকে সরে এসেছি। কিন্তু আমরা ভারতের অঙ্গরাজ্য নই। বন্ধুত্ব নামে বাণিজ্যের নামে এবং চোরচালানের মাধ্যমে ভারত আমাদেরকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে শোষণ করছে। কিন্তু ভারতীয় শোষণের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলনও করতে পারছি না। এমন কি ভারতের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন পত্রিকায় আমার মতো সাধারণ মানুষের লেখাও মুদ্রিত হয় না। এ নিয়ে ফোনে বাংলাদেশে কারো সাথে কথা বলতে চাইলে অভিন্ন উত্তর আসে: ভাই সরকার ও ভারতের বিপক্ষে যায় এমন কোন আলোচনা করবেন না। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে নেমেছে তা আমিও বুঝি। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড প্রধান তার দায়িত্বের গ-ির বাইরে গিয়ে দেশবাসীকে শাসিয়েছেন: বাংলার মাটিতে ভারতবিরোধী কোন প্রচারণা/তৎপরতা সহ্য করা হবে না। আমরা ভারতের বিরুদ্ধে কিছুই লিখছি না। ভারত যে আমাদেরকে শোষণ করছে, অন্যায় আচরণ করছে তা তুলে ধরতে চাই । কিন্তু সে অধিকারও আমাদের দেশের মানুষের নেই। বিষয় যেন এমন আমাদেরকে মারবে, কিন্তু আমরা কাঁদতেও পারবো না।

গত ৪৬ বছর যাবত প্রত্যেক বছর যা শোষণ করেছে, তা পাকিস্তানের ২৩ বছরের সর্বমোট শোষণের চেয়েও বেশী হবে । ভারতীয় পত্রিকায় ইকোনমিক টাইমস’এর অনলাইন ভার্সান একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে: ২০১৩-১৪ আর্থিক বর্ষে ভারত বাংলাদেশে বৈধভাবে রফতানী করেছে ৬.১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর আমদানী করেছে মাত্র ৪৬২ মিলিয়নের পণ্য। ২০১৮ সনে এ বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে চায়।

(http://economictimes.indiatimes.com/news/economy/foreign-trade/india-bangladesh-trade-may-almost-double-to-10-billion-by-2018-cii/articleshow/37126716.cms?intenttarget=no)

 অবৈধ তথা চোরচালানীর মাধ্যমে বাংলাদেশকে চুষে নেয়ার পরিমাণ নাকি বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলার। আমাদের সব শিল্পকারখানা ধ্বংস করে, এখন দর্জিদোকান (গার্মেন্টস কারখানা) পর্যন্ত বিভিন্ন কায়দায় কিনে নিচ্ছে, কিংবা বন্ধ করার চক্রান্ত করছে। এ ধরনের অবাধ শোষণ বাংলাদেশ ভারতভুক্ত না পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আমাদের প্রতি পাকিস্তানের দায়বদ্ধতা ছিল, যা ভারতের নেই। গণতান্ত্রিক ফলাফলকে অস্বীকার এবং শোষণ করার কারণে আমরা যদি পাকিস্তান ভেঙ্গে চলে আসতে পারি, তবে সীমান্তে বাংলাদেশীদের নির্বিচারে হত্যা, আন্তর্জাতিক নদীর পানি অবরোধ, বাণিজ্যের নামে শোষণ এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে  ব্যবহার করে অমূলক সুবিধা আদায় এবং নিরাপরাধ দেশপ্রেমিকদের নির্মূল করে বাংলাদেশকে দখল করার উদ্দেশ্য পক্সিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার অভিযোগে কোন যুক্তিতে বাংলাদেশ ভারতকে বন্ধুদেশ হিসেবে বিবেচনা করে প্রত্যেক ক্ষেত্রে ভারতকে মোকাবেলা করার পরিবর্তে তার সাথে কথিত প্রতিরক্ষা চুক্তি করবে? কোন দেশপ্রেমিকের পক্ষে এমন চুক্তি করা সম্ভব নয় । আমাদের সাথে অন্যায় আচরণ করার কারণে পাকিস্তান যদি শত্রু হয়, তবে ভারত বন্ধু হবে কোন বিবেচনায়? চোর আর ধোকাবাজ প্রতারক আর বর্ণচোরা ভারতকে বন্ধু বললে শত্রু কাকে বলবো? শত্রুকে শত্রুই বলব, বন্ধু নয়। আচরণগত কারণেই কেউ বন্ধু হয়, কেউ শত্রু হয়। বন্ধু শত্রুর ভূমিকায় নামলে তাকে শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। কোন দেশপ্রেমিক যাদের সামান্য ইতিহাস জ্ঞান রয়েছে, তারা ভারতকে বন্ধু বলতে পারেন না। যারা দেশের চেয়ে ক্ষমতা ও স্বার্থকে বড় করে দেখেন হয়তো তাদের কাছেই ভারত বন্ধু। সর্বোপরি কিছু অযোগ্য, ভূয়া বুদ্ধিবিক্রীজীবি, দুর্ণীতিবাজ রাজনীতি ব্যবসায়ী এবং ভারতীয় চর ছাড়া বাংলাদেশের ৯০% জনগণ ভারতকে বন্ধু মনে করেন না। যে ভারত প্রতিদিনই বাংলাদেশকে তার সাথে মিশে যাবার কথা বলে, তার মতো দুষমণের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করা মানে বাংলাদেশকে কাগজে-কলমে তার কাছে বন্দক রাখাই নয়, বাংলাদেশকে তার সাতপাকে বেঁধে ফেলার সুযোগ করে দেয়া। ভারতের মতো জানি দুষমণকে প্রতিহত করার জন্য আমরা প্রয়োজনে অন্যকোন দেশের সাথে সামরিক চুক্তি করবো, কিন্তু তা কোনভাবেই ভারতের সাথে নয়। কারণ এ মুহূর্তেই আমাদের দেশ ভারতের নানাবিধ অসামরিক হামলার মধ্যেই রয়েছে। আর সামরিক হামলা হলেও তা ভারত থেকেই হবে। তাই সম্ভাব্য আক্রমণকারীর সাথে প্রতিরক্ষা বা সামরিক সহযোগিতা চুক্তি নয়,  কেবল অনাক্রমণই চুক্তি হতে পারে।

১৯৭১ সন মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে ভারত আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাথে যে আচরণ করেছে, তা  তো শত্রুর ছবিকেই আমাদের চোখের সামনে নিয়ে আসে। ভারত আমাদের কাছ থেকে সবকিছু নিয়ে আমাদেরকে ঠকিয়ে  আমাদের পরম বন্ধু বলে দাবি করে, কিছু দিয়ে নয়। এই তো সেদিন বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত ও ভূটানের সমন্বয়ে চারদেশীয় ট্যানজিট চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিমতে চারটি দেশের মধ্যে একই সাথে যানবাহন চলাচল করার কথা। ঐ চুক্তি বলে ভারত বাংলাদেশর ভিতর দিয়ে তার পূর্বাংশে বলতে গেলে বিনা পয়সায় যাতায়াত করলেও বাংলাদেশ, নেপাল ও ভূটান ভারতীয় ভূখ- ব্যবহার করতে পারছে না। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কিংবা নিজেই পরিস্থিতি তৈরি করে ভারত তার ভূখ- চুক্তি স্বাক্ষরকারী বাকি তিনটি দেশকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। চুক্তি করে চুক্তি বানচালের কিংবা না মানার অসংখ্য নজির ভারত স্থাপন করেছে। বাস্তব কথা  হলো: ভারত মুখে যা বলে, চুক্তিতে যা লেখে বাস্তবে তার উল্টা করে।

১৯৭২ সনের ১৯ মার্চ ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত তথাকথিত মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তির অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ ঐ চুক্তিকে  গোলামীর চুক্তি হিসেবে ধিকৃত করেছিলেন। এমনকি শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ঐ চুক্তি নবায়ন করেন নি। কারণ ঐ চুক্তি আমাদের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী ছিল।  ঐ চুক্তির একটি ধারা (দশম) এখানে তুলে ধরছি: স্বাক্ষরকারী পক্ষদ্বয় “এক বা একাধিক দেশের সাথে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে এমন কোন প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হবে না, যা বর্তমান চুক্তির আলোকে অপ্রাসঙ্গিক/বেমানান হতে পারে।” এমন শর্তের দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌম ক্ষমতা কেবল সীমিতই নয়, বরং ভারতের কাছে বন্দী হয়ে যায়। সেই চুক্তির কথা মনে রেখে ভারতের সাথে নতুন কোন চুক্তি কোন দেশপ্রেমিক সরকার করতে পারে না ।

পর্যবেক্ষকমহল ভারতের সাথে ইতোমধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর ভয়াবহতা বিচার করে আশংকা করছেন: শেখ হাসিনা ভারতের সাথে এমন দেশবিরোধী চুক্তি করতে দ্বিধা করবে না। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ঠিকানা’র প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘ক্ষমতার বদলা চুক্তি’ । পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, হাসিনা এ চুক্তি করে তার ক্ষমতা থাকার ব্যবস্থা পাকা করলে বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে এ চুক্তিকে নিবে তা নিয়ে শেখ হাসিনা মোটেই চিন্তিত নন। কারণ তার ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। ভারতই তার ক্ষমতার উৎস। তিনি অবশ্যই ভুলে যান নি যে, ভারতই তাকে ২০০৮ কিংবা ২০১৪ সনে ক্ষমতায়  এনেছে এবং এখনো ভারতের কৃপায় তিনি ক্ষমতায় আছেন। অজানা সংখ্য মানুষকে রাজাকার মানবতাবিরোধী অপরাধী কিংবা প্রমাণ ছাড়াই জঙ্গী হিসেবে শেষ করে স্বাচ্ছন্দ্যে ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তার পেছনেও ভারত। ভারত এখন তাকে এ বলেও ভয় দেখাচ্ছে যে, ভারতের সমর্থন ছাড়া শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না, এবং একই কারণে তার ছেলের পক্ষেও বাংলাদেশে কোনকালে ক্ষমতায় আসা সম্ভব হবে না। শুধু তাই নয় তাদের পক্ষে বাংলাদেশে অবস্থান করাও সম্ভব হবে না। শেখ হাসিনা নিজেও বিষয়টি বুঝেন। সুতারং শেখ হাসিনা নিজের ও ছেলের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দেশের  অস্তিত্ব ভারতের হাতে তুলে দিবেন না এমনটা বলা যায় না। হয়তো শেখ হাসিনা ভারতের কাছ থেকে এমন ওয়াদাও করে আদায় করে আসতে পারেন যে, আগামী নির্বাচনের আগে এ চুক্তির কোন ঘোষণা দেয়া যাবে না, নির্বাচনের পর একটা মক্ সফরের মাধ্যমে এ চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরের অভিনয় করা হবে। এতে সাপ (বাংলাদেশ) মরবে কিন্তু লাঠি  (শেখ হাসিনার ক্ষমতা) ভাঙ্গবে না। বরং জনগণ সাময়িকভাবে হলেও শেখ হাসিনাকে দেশপ্রেমিক হিসেবে মনে করবেন।

পর্যবেক্ষক মহলের দুঃখ: এ ধরনের দেশবিরোধী চুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনমত তৈরি না করে ঢাকার সংবাদ মাধ্যম চুক্তির পক্ষে জোরালে প্রচারণা চালাচ্ছে। বিশেষত সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সেজে এ চুক্তির পক্ষে যেসব বাজে যুক্তি দেখাচ্ছেন তা শুনে বিস্মিত ও লজ্জিত হতে হয়। এরা কী কিছুই বুঝেন না, নাকি এরাও পচা বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকায় নেমেছেন, যারা কিছু প্রাপ্তির বিনিময়ে ভারতের হয়ে কাজ করছেন। এরা কি বুঝেন না, বাংলাদেশের উপর আঘাতটা কোন দিক হতে আসবে? ভারতের সাথে আমাদের প্রতিরক্ষা কিংবা সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরের কোন প্রয়োজনই নেই। প্রয়োজন থাকলে ছোট দেশ হিসেবে আমরাই ভারতকে এমন চুক্তির জন্য্য অনুরোধ করার কথা। উল্টা ভারত আমাদেরকে  চুক্তি স্বাক্ষরে  বাধ্য করছে।  সাথে ভিক্ষা (৫০০ মিলিয়ন ডলার) দেয়ার টোপ দিয়েছে। ভারত কতো নির্লজ্জ এবং কতো নিচে নামতে পারে বাংলাদেশকে তার সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করার এমন জোর-জবরদস্তি অদৃষ্টপূর্ব কুৎসিত উদাহরণ। এমন গায়ে পড়ে চুক্তির পিছনে বহু সুদূরপ্রসারী কুমতলব রয়েছে, যা বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে পারে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, শেখ হাসিনার জন-বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে ভারত বাংলাদেশের সর্বনাশ করার ফাঁদ তৈরি করেছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার দুর্বলতা এবং তাকে দিয়ে বাংলাদেশে মানুষ হত্যা করিয়ে তাকে গণ-বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আর এখন তাকে ভয় দেখিয়ে এ চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নিচ্ছে। এ চুক্তি হলে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা এবং তার ছেলের ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সামনে কতো বছর টিকবে তা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দেখা দিবে। ১৯৭১ সনে আমরা ভাবতে পারি নি, ভারত আমাদের সাথে কেমন ইতরের মতো আচরণ করবে, আমাদের সম্পদ লুটে নিবে, আমাদেরকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিবে না, আমাদের শিল্প-কারখানা শিক্ষা সংস্কৃতি শেষ করে দিবে। ঠিক তেমনি এ চুক্তির পরিণতির আরো কতো ভয়াবহ হবে, তা এ মুহূর্তে বুঝা যাবে যাবে না।

কোন দেশকে জোর করে চুক্তি স্বাক্ষর কেন করানো হয়, তা বুঝানোর জন্য সামরিক বাহিনীর জেনারেল হওয়ার প্রয়োজন হয় না, সাধারণ ক্ষেত মজুর কিংবা রিকসাওয়ালাও বুঝার কথা। কিন্তু আমাদের জেনারেলরা তা বুঝেও  এ চুক্তির ভয়াবহতার কথা না বলে, বরং ক্ষতিকর হবে না বলে ফতুয়া দিচ্ছেন । চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের ভালো হতে পারে, এমন কোন কাজ ভারত কখনোই করবে না। জেনারেলরা মনে হয় ভারতের চরিত্র এবং প্রতারণার ইতিহাস সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখেন না। অথচ এদেরই তো সরকারকে সাবধান করে দেয়ার কথা Ñ আমাদের কোন দেশের সাথেই প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রয়োজন নেই।  তথাকথিত সামরিক বিশ্লেষকরা এ চুক্তির ভয়াবহতা দেখার যাবার সময় না পেলেও তাদের পরবর্তী বংশধররা ৪৬ বছর পর কিংবা তারও আগে দেখবে কিভাবে আমাদের সেনাবাহিনী প্রথমত ভারতের চৌকিদার হয়ে ক্রমান্বয়ে শেষ হয়ে গেছে,  তথা বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন গেছে। এসব বিশ্লেষকদের রেখে যাওয়া অগাধ সম্পদ তাদের বংশদরদের হাত থেকে হিন্দুদের হাতে চলে যাবে, তাদের বংশধররা হিন্দুদের ঝি-চাকরে পরিণত হবে, যেমন ছিল ’৪৭’এর পূর্বে।

কূটনীতি তথা দেশের স্বার্থ হচ্ছে দাবার গুটির মতো, যখন যে দেশ থেকে যতো বেশি স্বার্থ ও সুবিধা আদায় করা যায় সে অনুযায়ী গ্রহণ বা বর্জন করতে হয়। রাজনীতিতে কূটনীতিতে দেশের স্বার্থে কোন স্থায়ী বন্ধু বা দুশমণ নেই। আজকে যে বন্ধু, আগামী দিন সে বন্ধু নাও থাকতে পারে। ভিয়েতনাম আমেরিকার বিরুদ্ধে ২৫ বছর যুদ্ধ করেছিল। ভিয়েতনামের এমন দুইহাত জায়গা পাওয়া কঠিন যেখানে আমেরিকার বোমায় ক্ষত-বিক্ষত হয় নি। এখন সেই আমেরিকা ভিয়েতনামের সবচেয়ে নির্ভরশীল বন্ধু, বিনোয়োগকারী ও আমদানীকারক। ঐ যুদ্ধে ভিয়েতনামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র ছিল চীন। চীন অর্থ, আশ্রয়, অস্ত্র, সশস্ত্রবাহিনী দিয়ে ভিয়েতনামকে বিজয়ী করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সেই চীনের সাথে ভিয়েতনামের সম্পর্ক বলতে গেলে একেবারেই দা-কুমড়া’র মতো। ভিয়েতনাম নিজে থেকেই চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। চীনের ক্ষুব্ধ হওয়াকে ভিয়েতনাম তোয়াক্কা করে নি। এটাই হলো দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের শক্তি ও চেতনার কাছে দুনিয়ার সব শক্তি পরাভূত হয়। আমরা ভিয়েতনামের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। চীনের কাছ থেকে যেকোন ধরনের সাহায্য নেয়ার সার্বভৌম অধিকার আমাদের রয়েছে। ভারত গোস্বা হলে আমাদের উত্তর একটাটই হওয়া জরুরী: তা হলো ভারতের চোখ রাঙানীকে তোয়াক্কা না করে চীনের সাথে আরো গভীর সম্পর্ক করা। ভারতের তোয়াজ করলে কিংবা ভারতের ধমকে নুয়ে পড়লে দেশ থাকবে না। ভারতের কাছে অনুনয়-বিনয় করলে কাজ হবে না। ভারত আমাদের পৃথক অস্তিত্বকে গিলে খেতে চায়, তাই আমাদের জন্য চীন বা আমেরিকা, এমনকি মায়ারমার, শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জরুরী। ভারত বলতে চাচ্ছে: আমরা যেন ভারতের আশ্রিত রাজ্য কিংবা রক্ষিতা, অন্যকোন দেশের সাথে আমাদের গভীর সম্পর্ক রাখার অধিকার নেই।

অন্যদিকে বাংলাদেশ কোনভাবেই কোনদেশের সামরিক হামলার হুমকির মুখে নেই। বাস্তবে ভারত ছাড়া বিশ্বে এমন কোন দেশ নেই, যেখান থেকে নিকট কিংবা দূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সামরিক আগ্রাসনের শিকার হতে পারে। মায়ারমারের সাথে আমাদের তেমন কোন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা থাকা সত্বেও বাংলাদেশ সব সময়ই ধৈর্য ও সমঝোতার পন্থা অলম্বন করেছে, মায়ানমারের সাথে সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে নি। বাংলাদেশ সব দেশের সাথে সম-মর্যাদাসম্পন্ন  বন্ধুত্বপূর্ণ বজায় রাখতে আগ্রহী। ভারত আমাদের চেয়ে আকারে, জনসংখ্যায়, সামরিক ও আর্থিক শক্তিতে অনেক বড়। এমন পরিস্থিতিতে ভারত কেন আমাদের সাথে সামরিক চুক্তি করতে এমন জেদ ধরেছে, তার গূঢ় উদ্দেশ্য বুঝতে হবে ।  এ জেদের পিছনে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে চরম চক্রান্ত লুকিয়ে আছে।

ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এবং আমাদের দেশে ভারতের হয়ে কাজ করেন এমন মহল বলে বেড়ান শেখ হাসিনা চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনার কারণে ভারত ক্ষুদ্ধ হয়েছে বিধায় তারা বাংলাদেশের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে মরিয়া। এটা কোন যুক্তির কথা নয়, এটা অজুহাত ছূতা। বাংলাদেশ চীনের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করলে সামরিক সরঞ্জাম কিনলে ভারতের উদ্বিগ্ন হবার কিংবা জেদ ধরার কোন যুক্তি নেই। আর উদ্বিগ্ন হলেও আমাদের তাতে ভীত হবারও কিছু নেই। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমরা যেকোন দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার, এমনকি সামরিক চুক্তি করার অধিকার রয়েছে । ভারত যে অধিকার বলে রাশিয়ার সাথে, পাশাপাশি আমেরিকার সাথে সামরিক চুক্তি করেছে, আমরাও  একই অধিকারে চীন, আমেরিকাসহ বিশ্বের যেকোন দেশের সাথে সামরিক চুক্তি করতে পারি।  এ অধিকার হারালে দেশ হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে আমাদের ভবিষ্যু সন্তানদের ভবিষ্যত। হারিয়ে যাবে আমাদের স্বাধীনতা, জাতির পিতা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় সংসদ, সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা, বিলাসিতা, এমনকি ধর্ম ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য । ক্ষমতা আর প্রলোভনের কাছে পরাজিত হয়ে ভারতের কথায় উঠাবসা করলে সবকিছুই হারিয়ে যাবে। আমরা যেন সে ভুল না করি। সে ভুল করার সুযোগ আমাদের নেই।*

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Social Share :
Comments

Comments

  • It is a long established fact that a reader will be distracted by the readable content of a page when looking at its layout. The point of using Lorem...
  • It is a long established fact that a reader will be distracted by the readable content of a page when looking at its layout. The point of using Lorem...
  • It is a long established fact that a reader will be distracted by the readable content of a page when looking at its layout. The point of using Lorem...